ঘটনার ঠিক দুবছরের মাথায় গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে ভয়াবহ জঙ্গি হামলায় জড়িত ২১ জনকে চিহ্নিত করে ৮ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র (চার্জশিট) দিয়েছে মামলার তদন্তকারী সংস্থা পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম এন্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিট। চিহ্নিত বাকি ১৩ জন বিভিন্ন সময়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে নিহত হওয়ায় মামলা থেকে তাদের নাম বাদ দেয়ার কথা বলা হয়েছে। আর ৮ জনের মধ্যে এখনো পলাতক রয়েছেন ২ জন। এ ঘটনায় বেঁচে যাওয়া ১৭ জনের জবানবন্দি নেয়াসহ সাক্ষী করা হয়েছে ২১১ জনকে। তবে এই চার্জশিটে নাম নেই হামলার পর আলোচনায় থাকা নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক হাসনাত রেজা করিমের। তদন্তে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কোনোভাবেই তার সম্পৃক্ততা পায়নি পুলিশ। অভিযানে নিহত হলি আর্টিজানের পাচক সাইফুল ইসলামকে শুরুতে সন্দেহের তালিকায় রাখা হলেও তার সম্পৃক্ততার কোনো প্রমাণ পাননি তদন্তকারীরা। এ ছাড়া গুলশান হামলাকারীদের সঙ্গে আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন আইএস, আল-কায়েদা বা অন্য সংগঠনগুলোর কোনো যোগসূত্র পাওয়া যায়নি। আর এ হামলার নেতৃত্বে ছিলেন জঙ্গি রোহান ইমতিয়াজ আর তার ডেপুটি কমান্ডার ছিলেন খায়রুল ইসলাম পায়েল। তারা হামলার অন্তত ৫ মাস আগে থেকেই যাবতীয় প্রস্তুতি নেন। গতকাল সোমবার ডিএমপি গণমাধ্যম কার্যালয়ে সিটিটিসি ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম দেশের নৃশংস এ জঙ্গি হামলার চার্জশিট জমা দেয়া পর সাংবাদিকদের এসব তথ্য জানান।
আদালত সূত্র জানায়, গতকাল বিকেলে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সিটিটিসির পরিদর্শক হুমায়ূন কবির ঢাকার সিএমএম আদালতে এ চার্জশিট দাখিল করেন। আদালতের প্রসিকিউশন সূত্র জানায়, ঢাকা মহানগর হাকিম নুর নাহার ইয়াসমিনের আদালতে চার্জশিটটি উপস্থাপন করার পর তা গৃহীত হয়েছে মর্মে স্বাক্ষর করেছেন। তবে আগামী ২৬ জুলাই মামলাটির প্রতিবেদন দাখিলের জন্য পূর্ব নির্ধারিত ধার্য তারিখে পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণ সম্পর্কে যথাযথ আদেশ পাওয়া যাবে। ২০১৬ সালের ১ জুলাই রাতে ক‚টনীতিকপাড়া গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলা চালিয়ে ১৭ বিদেশিসহ ২০ জনকে হত্যা করে জঙ্গিরা। তাদের ঠেকাতে গিয়ে দুই পুলিশ কর্মকর্তাও নিহত হন। রাতভর উৎকণ্ঠার পর ২ জুলাই সকালে সেনাবাহিনীর কমান্ডো অভিযান থান্ডারবোল্টের মধ্য দিয়ে সংকটের অবসান ঘটে। হামলায় অংশ নেয়া নব্য জেএমবির ৫ জঙ্গি নিবরাজ ইসলাম, মীর সামেহ মোবাশ্বের, রোহান ইবনে ইমতিয়াজ, খায়রুল ইসলাম পায়েল ও শফিকুল ইসলাম উজ্জ্বল নিহত হন ওই অভিযানে। আর পরে জঙ্গিবিরোধী বিভিন্ন অভিযানে হামলার মূল পরিকল্পনাকারী তামিম চৌধুরী, জাহিদুল ইসলাম, তানভীর কাদেরী, নুরুল ইসলাম মারজান, আবু রায়হান তারেক, সারোয়ার জাহান, বাসারুজ্জামান চকলেট ও ছোট মিজান নিহত হন। সিটিটিসির কর্মকর্তারা বলছেন, তদন্ত প্রতিবেদনে চিহ্নিত ২১ জনের মধ্যে ৫ জন গুলশান হামলায় সরাসরি অংশ নেন। বাকিরা হামলার পরিকল্পনা, সমন্বয়, প্রশিক্ষণ এবং অস্ত্র, বোমা সংগ্রহসহ বিভিন্ন পর্যায়ে জড়িত ছিলেন। গত বছর মনিরুল বলেছিলেন, হামলার মাস্টারমাইন্ড তামিম চৌধুরী, মূল প্রশিক্ষক (মাস্টার ট্রেইনার) মেজর জাহিদ কিংবা তানভীর কাদেরি, নুরুল ইসলাম মারজান ছিলেন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আসামি। পুলিশ কর্মকর্তাদের ভাষ্য, গুলশান হামলার জন্য বগুড়ার দুই জঙ্গিকে নিয়োগ করেন রাজীব আর বসুন্ধরায় বাসা ভাড়া ও জঙ্গিদের উদ্বুদ্ধও করেন তিনি। সাগর সীমান্তের ওপার থেকে আসা অস্ত্র ঢাকায় মারজানের কাছে পৌঁছান। বাশারুজ্জামান মধ্যপ্রাচ্যের একটি দেশ থেকে দুই দফা হুন্ডির মাধ্যমে আসা ২০ লাখ টাকা নেন এবং সেই টাকা গুলশান হামলায় ব্যবহৃত হয়। সিটিটিসি প্রধান মনিরুল ইসলাম সোমবার বলেন, জীবিত ৮ আসামির মধ্যে ৬ জন কারাগারে আছেন, বাকি দুজন পলাতক। কারাগারে থাকা ৬ হলেন- জাহাঙ্গীর আলম ওরফে রাজীব গান্ধী, রাকিবুল হাসান রিগান, রাশেদুল ইসলাম ওরফে র্যাশ, সোহেল মাহফুজ, মিজানুর রহমান ওরফে বড় মিজান এবং হাদিসুর রহমান সাগর। পলাতক ২ আসামি শহীদুল ইসলাম খালেদ ও মামুনুর রশিদ রিপনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্রে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা চাওয়া হয়েছে।
তিনি আরো বলেন, হামলাকারীদের উদ্দেশ ছিল দেশকে অস্থিতিশীল করা, বাংলাদেশকে একটি জঙ্গি রাষ্ট্র বানানো, সরকারকে চাপের মুখে ফেলা। তাই হামলার জন্য শুধু হলি আর্টিজানই নয়, আরো কয়েকটি জায়গায় রেকি করেছিল জঙ্গিরা। কিন্তু সর্বোচ্চ সংখ্যক বিদেশি একসঙ্গে পাওয়া, হামলার পর এখান থেকে সরে পড়ার সুবিধা ও সেখানকার নিজস্ব নিরাপত্তা ব্যবস্থা দুর্বলতার কারণে তারা আর্টিজানকেই টার্গেট হিসেবে বেছে নেন। এ ঘটনার সঙ্গে আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠনের সম্পৃক্ততা ছিল কিনা সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে সিটিটিসি প্রধান বলেন, এ ঘটনায় তামিম, সারওয়ার, মারজানের মতো নব্য জেএমবির শীর্ষ নেতাদের কাউকেই জীবিত গ্রেপ্তার করা যায়নি। তারা অভিযানে নিহত হয়েছে। এদের জীবিত গ্রেপ্তার করতে পারলে নিশ্চিত হতে পারতাম। কিন্তু অন্য যাদের জীবিত গ্রেপ্তার করেছি, তাদের জিজ্ঞাসাবাদ এবং আমাদের টেকনোলজিক্যাল এভিডেন্সে আন্তর্জাতিক যোগাযোগের কোনো তথ্য-প্রমাণ পাইনি। তবে আমরা মনে করি, তদন্তে আমাদের যে একটা ল্যাকিংস সেটি ছিল, যেসব কেন্দ্রীয় নেতা বিভিন্ন অভিযানে নিহত হয়েছে। এদের জীবিত গ্রেপ্তার করতে পারলে আরো তথ্য পেতে পারতাম। তিনি আরো বলেন, এ ঘটনায় সাইফুল্লা ওযাকির কিংবা বিদেশে অবস্থানরত অন্য কারো নাম কিংবা আন্তর্জাতিক সংগঠনের নাম পাইনি। নব্য জেএমবির নেতাদের সঙ্গে থাকলেও থাকতে পারত। তবে তামিম যেহেতু নেতা, আন্তর্জাতিক কারো সঙ্গে যোগাযোগ করলে তারই করার কথা ছিল। এ ছাড়া তার ইলেকট্রনিক ডিভাইসগুলো অভিযানের আগেই ধ্বংস করে পুড়িয়ে দেয় সে। তাই বিদেশি কোনো সংগঠন, আইএস কিংবা আল-কায়েদা, হিযবুত তাহ্?রীর কিংবা অন্য কোনো সংগঠনের সঙ্গে যোগাযোগের তথ্য আমরা পাইনি। অপর এক প্রশ্নের জবাবে মনিরুল ইসলাম বলেন, এ মামলার সব মিলে মোট সাক্ষীর সংখ্যা ২১১ জন। এদের মধ্যে ১৪৯ জন ঘটনা সম্পর্কে জানে কিংবা ঘটনা দেখেছে, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জানে। ৭৫টি আলামত আদালতে পাঠানো হয়েছে।
Leave a Reply